ইরান ইস্যুতে তড়িঘড়ি কেন সমঝোতার পথ বেছে নিলেন ট্রাম্প
ইরান ইস্যুতে তড়িঘড়ি সমঝোতার পথ বেছে নিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক কৌশল বরাবরই কঠোর ও আগ্রাসী। এর কেন্দ্রে রয়েছে ইরান যা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে পরমাণু বোমা তৈরিতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্র। দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য ও নিরাপত্তা নীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ শুধুমাত্র এই ইরান।
ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠোর অবস্থান সম্প্রতি চূড়ান্ত রূপ নেয়-যখন গত মাসে ইরানের ফোরদো পরমাণু কেন্দ্রে বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমানের মাধ্যমে বিশালাকার বোমা দিয়ে হামলা চালানো হয়। বাঙ্কার বাস্টার বা ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংসে সক্ষম এই বোমা দেশটির সবচেয়ে বড় এই পরমাণু কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা অনুযায়ী এই হামলার নেতৃত্ব দেয় তেলআবিব ঘনিষ্ঠ ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে হামলাটি নিজস্ব নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ রক্ষার জন্য হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয়- এটি ছিল নেতানিয়াহু সরকারের প্ররোচনার একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর নির্লজ্জ আগ্রাসন।
বিস্ময়করভাবে, সেই ট্রাম্প প্রশাসন তীব্র যুদ্ধাবস্থা তৈরি করার পর আবার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। ওয়াশিংটনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কার্যকর হয় এই যুদ্ধবিরতি, যার ফলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সরাসরি সংঘাতে জড়ানো থেকে বিরত থাকে। প্রশ্ন উঠছে-এই দ্বৈত নীতির পেছনে আসলে কী উদ্দেশ্য লুকিয়ে রয়েছে?
এই পরিস্থিতির মধ্যেই ইরানের দুই শক্তিশালী মিত্র-রাশিয়া ও চীন ভিন্নধর্মী কূটনৈতিক সাড়া দেয়। রাশিয়া ইরানকে পরমাণু প্রযুক্তি সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দেয়। চীন সরাসরি অস্ত্র সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এতে ওয়াশিংটনে নতুন উদ্বেগ দেখা গেছে। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে কঠিন বার্তা- মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য চীনা-রুশ প্রভাবের দিকে হেলে পড়ছে। ট্রাম্প প্রশাসন বুঝে যায়, কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখলে ইরান চূড়ান্তভাবে বেইজিং-মস্কো জোটে চলে যেতে পারে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
ঠিক এই মুহূর্তে, ট্রাম্প প্রশাসন এক নাটকীয় পালাবদলের মধ্য দিয়ে সমঝোতার পথ বেছে নেয়। যুদ্ধাবস্থা থেকে একধরনের নিয়ন্ত্রিত সহাবস্থানে যাওয়ার ইঙ্গিত দেখা যায়। বিশেষ করে- ইরানের সঙ্গে নতুনভাবে কূটনৈতিক চ্যানেল চালু করার চেষ্টা, পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত রাখার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার আলোচনা ও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনা কমিয়ে আনার আহ্বান।
ইরান ইস্যুতে ট্রাম্পের এই ইউ-টার্ন অনেকের কাছে ধোঁয়াশাপূর্ণ মনে হলেও, এটি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার একটি কৌশলী প্রয়াস। একদিকে ইসরায়েলের চাপে সাময়িক শক্তি প্রদর্শন, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন জোটকে রুখে দেয়ার প্রয়োজনে কূটনৈতিক নমনীয়তা-এই দুই মেরুর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাচ্ছে হোয়াইট হাউস।
ট্রাম্পের এই সমঝোতামূলক অবস্থান কি ইরানের সঙ্গে একটি স্থায়ী সমাধানের পথে এগোবে, নাকি এটি কেবল সময়ক্ষেপণ? উত্তর হয়তো জানান দেবে ভবিষ্যতে আলোচনার টেবিলে হওয়া চুক্তিপত্র।
এ প্রসঙ্গে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক এবং মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ড. ফাওয়াজ গার্গেস বলেন, ‘এই ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে এখন আর আগের মতো মধ্যপ্রাচ্যে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেই যুক্তরাষ্ট্রের। ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন-ইরানকে সামরিকভাবে কোণঠাসা করা মানেই তাকে চীন ও রাশিয়ার সরাসরি জোটে ঠেলে দেয়া, যা ওয়াশিংটনের কৌশলগত পরাজয় ডেকে আনবে।’
অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশনের দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা বিশ্লেষক তৃষিতা সেন বলেন, ‘এই হামলা এবং পরবর্তী যুদ্ধবিরতি ছিল একধরনের ‘স্টেজড অ্যাকশন’-যেখানে ট্রাম্প প্রথম শক্তি প্রদর্শন করে ইসরায়েলকে খুশি রাখলেন, তারপর আবার মধ্যস্থতায় গিয়ে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে দেখানোর সুযোগ নিলেন।’
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ রবার্ট ম্যালি বলেন, ‘আমরা দেখছি এক দ্বিমুখী কূটনীতি—ট্রাম্প প্রশাসন চায় না ইরান তার সমস্ত কৌশলগত ভারসাম্য চীন-রাশিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দিক। তাই যুদ্ধের হুমকি দিয়ে চাপে রাখার পর আবার কূটনৈতিক দরজা খোলা রাখছে। এটি ক্লাসিক ‘কারোট অ্যান্ড স্টিক’ পলিসি।’
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইরানের শীষ কূটনীতিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন বুঝতে পারছে শক্তি প্রয়োগ দিয়ে ইরানকে দমন করা সম্ভব নয়। কিন্তু ইরান জানে-সমঝোতার টেবিলেও ঢোকার আগে শক্তির জানান দিতে হয়। তাই যুদ্ধবিরতি এখন নতুন সমীকরণের সূচনা মাত্র।’
ব্রাসেলসের মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতি বিশেষজ্ঞ মারিয়া হিলার্ড বলেন, ‘এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, মধ্যপ্রাচ্যে নয়া বিশ্বশক্তির জোট তৈরির আশঙ্কা এখন বাস্তব। ট্রাম্প তাই সাময়িক সমঝোতা দিয়ে সময় কিনছেন। কিন্তু এই সময় যদি কাজে না লাগে, তাহলে নতুন সংঘাত অনিবার্য।’